পূর্ব থেকেও পশ্চিমাদেশগুলো চাচ্ছিল যেকোনো ভাবে চীন দেশে বাণিজ্য করতে। কিন্তু চীনের রুদ্ধদ্বার নীতির কারণে পশ্চিমাদেশগুলো সুযোগ পাচ্ছিল না তাদের সাথে ব্যবসা করতে। মূলতঃ চীন ছিল এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে সবকিছুই উৎপন্ন হত। যেকারণে বৈদেশিক বাণিজ্য তাদের তেমন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী দেশ বৃটেইনসহ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, পর্তুগাল ইত্যাদি দেশগুলো চেয়েছিল চীনের সাথে বাণিজ্য করতে। কারণ চীনের কাঁচামাল নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো বেশি লাভাবান হচ্ছিল। শুধু তাই নয় পশ্চিমাদের মূল আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল চীনের বন্দরগুলো ব্যবহার করা।বাঁধা হলো চীনের সম্রাটের সাথে দেখা করতে বা কোন চুক্তি করতে গেলে সে দেশেরই কর্মকর্তা বা যাই হোক না কেন তাকে অবশ্যই চীনের প্রচলিত প্রথা তথা কাউটাউ প্রথা মেনে অর্থাৎ হাটু গেড়ে রাজাকে কুর্ণিশ করে নজরানা দিয়ে দেখা করতে হয়। এতসব অপমান মেনে নিয়েও তারা চীনের সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছিল। উল্লেখ্য যে, ব্রিটেন থেকে ১৭ বার কর্মকর্তারা সম্রাটের সাথে দেখা করতে গিয়ে ১৬ বারই তাদের এই প্রথা মেনে নিতে হয়। বিদেশীদের উদ্দেশ্য একটাই চীনের সাথে বাণিজ্য করা।এরই ধারাবাহিকতায় ব্রিটেন বিভিন্ন শর্ত মেনে নিয়ে চীনে বাণিজ্য করার সুযোগ পায়। তারা এসব সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক পরিমাণ আফিম চোরাই চালান করতে সক্ষম হয়।
আফিম যুদ্ধ কিছু অন্যতম কারন>>
- প্রথম কারন ছিল বণিকদের বিশাল পরিমান আফিম চীনা কমিশনার কর্তৃক ধ্বংস যা বিদেশী বণিকদের নিকট নিতান্তই অপমান জনক।
- দ্বিতীয় কারণ ছিল ব্রিটিশ বিণিকদের হাতে একজন চীনা নাগরিক নিহত হয়। এ ক্ষেত্রে কমিশনার এলিয়ট (বৃটেনের) ন্যায় বিচার না করে প্রহসনমূলক বিচার করলে বৃটেনের কমিশনার ক্ষেপে যায়।
- চীনের নজরানা প্রথা, ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথা এবং কাউটাউ প্রথাও এ যুদ্ধের পিছনে অন্যতম কারণ।
- বৃটেন তথা পশ্চিমা বিশ্বের মূল টার্গেট ছিল সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। এই আগ্রাসনের জন্য তারা কোন একটি কৌশল এবং অজুহাত খুঁজতেছিল। এবং আফিম ব্যবসা ছিল এরই একটি পূর্ব কুটচাল বা একটি ফাঁদ। যে কারণে চীনারা বার বার পদক্ষেপ নিয়েও আফিমের ব্যবসা বন্ধ করতে পারেনি। এর আগেও তারা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবসা করতে এসে ভারতীয় উপমহাদেশে ক্ষমতা বিস্তার করে ছাড়ে।
এসব কারনে ১৮৪০ সালে এ্যাডমিরাল এলিয়টের নেতৃত্বে ইংরেজরা প্রচুর সৈন্য ও অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে চীনে আক্রমন করে। চীনারা এই আক্রমন প্রতিহত করে নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর হয়। এভাবে প্রথম ঈঙ্গ-চীন যুদ্ধ তথা প্রথম আফিমের যুদ্ধ সূচনা ঘটে।
আফিমের ব্যবসার যা যা প্রভাব পড়েছিল>>>চীনে আমেরিকান এবং ব্রিটিশ বণিকগণ আফিমের চোরাই চালান শুরু করেছিল মূলত ১৭৮০ সালের দিকে। প্রথম দিকে চীনারা চা, রেশম, চীনা মাটির বাসন ও অন্যান্য পণ্য সামগ্রী দিয়ে বিদেশী বণিকদের নিকট থেকে আফিম ক্রয় করত। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে চীনে আফিমের চাহিদা এত অধিকহারে বেড়ে গিয়েছিল যে, তখন তাদের আর উৎপাদিত পণ্য দিয়ে আফিমের দাম পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছিল না। সুতরাং তারা রৌপ্য মুদ্রা দিয়ে আফিম ক্রয় করতে শুরু করে। এতে চীনা রৌপ্যের ভাণ্ডার বিদেশে চলে যেতে থাকে। ফলে চীনে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেবার আশংকা চলে আসে।চীনা জনগণের আফিমের প্রতি নেশা এত অধিক হারে তৈরি হয়েছিল বিশেষ করে যুব সমাজ একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছিল।এর মাধ্যমে বিদেশী বণিকরা চীনে প্রবেশ ও স্থান নেয়ার সুযোগ পাচ্ছিল। যেটা আসলে চীনা সরকারের নিয়ন্ত্রেনের বাইরে চলে যাবার আশংকা ছিল।
যুদ্ধ অবসান >>যুদ্ধে পরাজিত হয়ে চীনা সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য চীনা সম্রাট চিয়া চিং দ্রুত ইংরেজদের সাথে শান্তি স্থাপনে ব্যগ্র হন। প্রথমেই দেশপ্রেমিক লিন সে সুকে পদচ্যুত করে নির্বাসিত করা হয় এই অপরাধে যে তার ‘হঠকারী পদক্ষেপ’ এই যুদ্ধের জন্য দায়ি। এরপর চীনা সামন্ততান্ত্রিক সরকার কতকগুলো অপমানজনক শর্ত মেনে নিয়ে বৃটিশদের সাথে একটি অসম চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। যে চুক্তিটি নানকিং এর চুক্তি নামে পরিচিত। ১৮৪২ সালের ২৯ আগস্টে নানকিংয়ের চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে প্রথম আফিমের যুদ্ধের আবসান হয়।


Post a Comment